সকাল সকাল উঠেই নাস্তা করে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। যেহেতু সিলেটে থাকি তাই আগে সিলেট থেকে ঢাকা গিয়ে সেখান থেকে বাকী দলের সাথে জয়েন করতে হবে। সকাল সকাল এনা পরিবহনে করে সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। পুরো পথটাই কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছাড়া কেটে গেল। বিকালের দিকে ঢাকা প্রবেশ করেই পড়লাম ঢাকার বিখ্যাত জ্যাম এ। ঢাকার মানুষজন জ্যাম দেখে অভ্যস্ত হলেও আমাদের এইরকম ভয়াবহ জ্যাম এ পড়তে হয় না। ৫ কিলোমিটার পাড়ি দিতে সময় লাগলো পাক্কা ১ ঘন্টা। আব্দুল্লাপুর বাস স্টেশনে নেমে গেলাম। রাত ৮ টার সময় ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির বাস ছাড়বে। হাতে অনেক সময়। তাই বাস কাউন্টারে হাত মুখ ধুয়ে হাল্কা নাস্তা সেরে নিলাম। সেখান থেকে মাস্কট প্লাজায় চলে গেলাম। কোনো কিছু কেনার উদ্দ্যেশ্য ছিলো না। শুধু সময় কাটানোর জন্য আসা। তবে এমন কিছু চোখে পড়লো না যেখানে সময় কাটানো যায়। মূলতো ঢাকার এই প্রবেশপথে শুধু বাসস্ট্যান্ড আর শপিংমল ছাড়া তেমন কিছু নেই। আর ট্রাভেলিং এ আনাড়ি হওয়ার ফলে ব্যাগ ভর্তি করে অযথা সব কাপড়চোপর নিয়ে ব্যাগ ভারী করে ফেলেছিলাম। কাজেই এই ব্যাগ কাধে নিয়ে ঘুরার কোনো মানেই হয় না। তাই বাস কাউন্টারে সময় কাটানোই শ্রেয় মনে করলাম। রাত ৮ টার সময় সবাই একত্র হয়ে বাসে উঠলাম। ২৩ জন ছিলাম আমরা। বেশীরভাগই রাস্তা থেকে যাওয়ার সময় উঠবেন। এই প্রথম দেখলাম এই রকম ইভেন্ট ব্যবসা চালানো আসলে বেশ ঝামেলার একটি কাজ। একেকজনকে একেক যায়গা থেকে পিক করতে হলে যথেষ্ট ধৈর্য্য লাগে। সবাই উঠতে উঠতে প্রায় ২ ঘন্টার মতো সময় লাগলো। রাতে একবার শুধু একটা খাবারের দোকানে কিছু সময়ের জন্য বিরতি দিয়ে আবার যাত্রা শুরু। তবে ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেই দৃশ্য দেখেছি সেইটা আশা করি অনেকদিন মনে থাকবে। যারা পাহাড়ে বাস করেন তাদের কাছে হয়তো হটাৎ করে মেঘের ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করা নতুন কিছু নয়। কিন্ত যারা সমতলে থাকেন তাদের কাছে যে এই বিষয়টা কতোটা উপভোগ্য তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ঘন কুয়াশার মতো মেঘের ভেতর দিয়ে বাস এগুচ্ছিলো। ভোর ৬ টার দিকে সাজেকে পৌঁছাই। শুক্রবার দিন হওয়ায় মানুষ ছিলো মাছ বাজারের ভিড়ের মতো। আমরা যেই রেস্তোরায় ঢুকলাম সেটার নাম ছিলো মনটানা। সকাল বেলার নাস্তা দেওয়া হলো। এবার সবার সাথে পরিচিত হওয়ার পালা। আমাদের দলে কাপল ছিলো ৩ জোড়া। বাকী সব ছেলেরা আলাদা আলাদা ভাবে এসেছে। ৮ টার দিকে আমাদের গাড়ি ঠিক হলো। চাঁদের গাড়িতে উঠে মোটেও নিজেকে চাঁদের যাত্রী মনে হয় নি। একটা জীপের ভেতর ঠেলাঠেলি করে ১০ জন ঢুকিয়ে দিলে যা অবস্থা হয় আরকি। কোনো রকমে পশ্চাতদেশ সীটে লাগিয়ে বসা। গাড়ি চলতে শুরু করার সাথে সাথেই একটু চমকে গেছিলাম। কারন ৭০ কিংবা ৮০ দশকের গাড়ির জোর যে এতো হতে পারে তা চিন্তাও করতে পারতাম না। আর ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলো। বুড়ো বয়সে কেউ সাজেকে যেতে চাইলে কোমরে সাপোর্ট বেল্ট না বেধে গেলে খবর হয়ে যাবে। কম বয়সী হওয়ায় আসলে এত্তো গতিতে ছোটে চলা উপভোগই করছিলাম। কিছু সময়ের ভেতরেই চলে এলাম দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্প এ। সেখান থেকে নাকি আর্মিরা এস্কর্ট করে সবাইকে নিয়ে যাবে। তো তাদের এস্কর্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার পালা সহজে শেষ হয়না।
আর ১০ টার সময় এস্কর্ট থাকলেও এত্তো মানুষের এত্তো গাড়ি সামলাতে সামলাতে একটু বেশী সময় লাগারই কথা। সেনা সদস্যদের দেখতে পেলাম গাড়ি নিয়ন্ত্রন করছে। একজন সেনা সদস্য তো এক ড্রাইভারকে চড় মেরেই বসলেন। ড্রাইভারের দোষ ছিলো গাড়ি উল্টো পথে গাড়ি পার্কিং করেছিলো। বাংলাদেশে বিষয়টা স্বাভাবিক লাগলেও আমার কাছে খুবই খারাপ লাগে এরকম কোনো কিছু ঘটতে দেখলে। একজন সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে আইন কখনোই কারো উপরই হাত তুলতে পারমিশন দেয় না। যাই হোক সাড়ে ১১ টার দিকে চলতে শুরু করলো গাড়ি। পিপড়ের লাইনের মতো দীর্ঘ গাড়ির লাইন। সাজেকে যেতে সময় লাগে ৪-৫ ঘন্টার মতো। সময়টা শুনে অবাক হলেও আসলে এই সময়টা গায়ে লাগে না। কারন অনেকে মিলে গল্প করে এগুতে শুরু করলে সময়ের আর হিসাব থাকে না। আস্তে আস্তে আমরাও পরিচিত হতে শুরু করলাম। আমি উঠেছিলাম কাপলদের গাড়িতে। কাপলরা ছাড়াও আরো কয়েকজন ছিলো। আমাদের দলের এডমিন সাহেবকে উঠতে দেখেই আমিও এই গাড়িতে উঠেছিলাম আরকি। তো কিছু দূর যাওয়ার পরই গাড়ির চাকা ফুসসস। গাড়ি সাইড করিয়ে ড্রাইভার শুরু করলো চাকা চেঞ্জ করা। ৩০ মিনিটের ব্রেক শেষে আবার চলা শুরু। অনেকের কাছেই শুনেছি এই রাস্তার জার্নি টাই নাকি অনেক সুন্দর। আমার কাছে সুন্দরের কিছুই মনে হয়নি। আসলে দীর্ঘ পাহাড়ি পথে সবাই আড্ডা দিতে দিতে যায় বলেই এতো সুন্দর মনে হয়। পাহাড়ি রাস্তা হটাৎ করেই ৩০-৪০ ডিগ্রি খাড়া উপরের দিকে উঠে যায়। আর একটু পরে পরেই জ্যাম। সবমিলিয়ে বিরক্তির একশেষ। জ্যামের মূল কারন হচ্ছে বড়লোকদের অতি বিলাসিতা। নিজের একটা গাড়ি থাকলেই সেটা নিয়ে আরাম করে বেড়িয়ে পড়তে হবে বলে তাদের ধারনা। সেই গাড়িটা পাহাড়ি পথে চলার উপযোগী কি না তা ভাবার সময় নেই। পাহাড়ি রাস্তায় যখন কোনো রাস্তা খাড়া উপরের দিকে উঠে যায় তখন গাড়ি গুলো একটা একটা করে উপরের দিকে উঠে। কারন কোনো গাড়ি স্লিপ করে নিচের দিকে পড়লে বাকী গুলোকে নিয়েই পড়বে। তাই একটা পাস হওয়ার পর আরেকটা গাড়ি উপরে উঠা শুরু করে। জীপ গুলোর তেমন সমস্যা হয় না। কারন এগুলি পাহাড়ে উঠার জন্যই তৈরী। কিন্ত এই হাইএস, নোহা, ফিল্ডার গুলো যতো ঝামেলা বাধায়। একেকটা চড়াই উঠার সময় গাড়ি গুলোর চাকা স্লিপ করে পিছিয়ে আসতেও শুরু করে। একটু আগায় তারপর একটু পিছায়। এভাবে করে উপরে ওঠে। ফলে বাকীদের দীর্ঘ লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আর একবার স্লিপ কেটে পড়তে পারলেই পাহাড়ের নিচে ধপাস। কি দরকার এতো রিক্স নিয়ে বিলাসীতা করার? বাজী ধরে বলতে পারি তাদের এসি লাগানো গাড়িতে করে এই পথ পাড়ি দেওয়ার চাইতে শতগুন বেশী রোমাঞ্চ এই জীপ গাড়িতে আছে। সাজেকে ঢুকার শেষ ৩ কিলো পথ এক্কেবারে খাড়া। কাজেই একটু একটু অপেক্ষা করে যখন আমাদের জীপটা একটানে সাজেকের উপরে উঠে আসলো সমস্ত ক্লান্তি এক দৃশ্যই ঘুচিয়ে দিলো।
![]() |
দার্জিলিং রিসোর্টের বেলকোনী থেকে |
১/ সাজেকের বিকাল.......(সাজেক দুই)
২/ বিদায় সাজেক.....(সাজেক তিন)
Comments
Post a Comment